ঢাকা, ২৩ নভেম্বর শনিবার, ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৬১৪

ঘুরে ফিরে তিনিই টার্গেট 

আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:১০ ২৮ মার্চ ২০২১  

বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী একটি বিশেষ গোষ্ঠী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। কারণ তিনি তাদের সাধের পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই 'অপরাধে'র কারণে জাতির পিতা বারবার তাদের টার্গেটে পরিণত হন। তারা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। নিহত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এক অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে দীর্ঘকাল। প্রতিনিয়ত পরাজিত হওয়ার পরও বংশানুক্রমে এরা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। 


ওই বিশেষ গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে রেখে শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ, ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। তাঁর নাম উচ্চারণ করা, উনার কর্ম ও স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এক ধরনের 'দেশদ্রোহী' অপরাধের সামিল ছিল। এখন তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে বিভিন্নভাবে তাঁকে অপমান করার এক হিংস্র নেশায় মত্ত রয়েছে। যেকোনও বিষয়কে অজুহাত করেই সংঘবদ্ধ হয়ে কাপুরুষের মতো রাতের অন্ধকারে অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাময়িক অনুপস্থিতির সুযোগে জাতির জনকরে ছবি, প্রতিকৃতি, ভাস্কর্যের ওপর আঘাত হেনে পৈশাচিক উল্লাস করছে। ঘুরে ফিরে তাদের টার্গেট পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টিকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। 

 

তিনি যেন বাঙালির জন্য স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করে মহা 'অপরাধ' করেছেন। ওই বিশেষ গোষ্ঠীর টার্গেট যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়, উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা হয়। তাহলে তাদের বিবেচনায় থাকা উচিত ছিল, বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখের ওপর নয় এবং পেয়ারের পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা ৮০ লাখের কাছাকাছি। আর ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। এসব ধর্মান্ধ উগ্র ব্যক্তির উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে ভারতে মুসলমান বিরোধী সেন্টিমেন্ট যদি তীব্রতর হয়। যদি আবার কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত ধর্মীয় দাঙ্গার উদ্ভব হয় এবং তা অদমনীয় রূপ পরিগ্রহ করে; তাহলে ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের নিরাপত্তা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে? 


বিশাল ভূখণ্ড ভারতে বাংলাদেশের হিন্দু এবং তাদের প্রিয় পাকিস্তানের হিন্দু মিলিয়ে ৩ কোটি মানুষের আশ্রয় খুব বড় সমস্যা হবে না। কারণ ২০ কোটি মুসলমান তারা খেদিয়ে দিতে পারবেন। আমরা অথবা পাকিস্তান মিলিয়ে কি ইসলাম ধর্মাবলম্বী ২০ কোটি মানুষের আশ্রয় এবং উন্নত জীবন দিতে পারব? কই, ৫০ বছরেও পাকিস্তানে বিশ্বাসী গুটিকতক বিহারী মুসলমানকে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যায়নি, তাদের প্রবেশে অনুমতি দেয়নি? কিসের আশায় কতিপয় কুলাঙ্গার বাঙালি মুসলমান অপর দেশের টাকায় পুষ্ট হয়ে ভারত বিরোধিতার নামে বিদ্বেষ ছড়ানোর খেলায় মত্ত রয়েছেন? 

 

আপনারা কি জানেন না, বঙ্গবন্ধু নিজেও পাকিস্তান আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন? তিনি মুসলিম লীগের প্রধানতম ছাত্রনেতা হিসেবে ১৯৪৭ সালে সংঘটিত নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অকুতোভয় সিপাহসালারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কলিকাতা ও বিহারের মজলুম মুসলমানদের রক্ষায় প্রধানতম ভুমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন উনি দেখেছেন, নতুন রাষ্ট্রে বাংলার জনগণের ভাগ্য পূর্বের চেয়েও নিকৃষ্ট অবস্থানে নেমে এসেছে। তখন বাঙালির জন্য স্বাধীন, সার্বভৌম আবাসভূমির স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্ন সঞ্চারিত করে বাংলার জনগণকে সংগঠিত করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই দেশের সিংহভাগ মানুষ মুসলমান, ফলে বাঙালি মুসলমানের জন্যই এই আদর্শ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। 


শুধু তাই নয়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণের অকুন্ঠ সমর্থন, সহযোগিতা স্বাধীনতা লাভে পরম সহায়ক ভুমিকা পালন করেছে। তাদের সৈন্যবাহিনী আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে আত্মসমর্পণের পূর্বে একটি শেষ শর্ত দিয়েছিল। যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সৈন্যবাহিনী নয়, সুতরাং একটি প্রাতিষ্ঠানিক বাহিনী হিসেবে কেবল তারা অপর প্রাতিষ্ঠানিক বাহিনী হিসেবে ভারতের সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। 


জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যেন পরাজিত- আত্মসমর্পণকারী সেনাদের যুদ্ধবন্দির নিরাপত্তা ও মর্যাদা দেওয়া হয়। তখন জাতিসংঘে ভেটো প্রদানে সক্ষম পরাশক্তির কেউ কেউ বাংলাদেশ নিয়ে এক গভীর ষড়যন্ত্রের খেলায় মত্ত ছিল। সেই অবস্থায় সঙ্গত কারণেই ভারতের সেনাবাহিনী সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে একক কর্তৃত্বে আত্মসমর্পণ করিয়ে সমস্ত ক্রেডিট এবং যুদ্ধ পরবর্তীতে ভারতীয়দের স্ট্যাটেজিক সুবিধা নিতে পারতো। কিন্তু ভারত সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অকুতোভয় অবস্থানের কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করে। সমগ্র বিশ্বে এক নতুন রাষ্ট্রের শত্রুমুক্ত অভ্যুদয় ঘটে। 


বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং প্রহসনের বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। এই বিষয় সবাই জানেন। সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী শেখ মুজিবের পর্বতপ্রমাণ ইমেজ এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিচক্ষণ কূটনৈতিক তৎপরতায় পাকিস্তানিরা ভীত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে প্রথমেই ভারতের ঝানু পলিটিশিয়ান, আমলা, কূটনীতিকদের বুঝতে না দিয়ে নিজের জগৎজোড়া ব্যক্তিগত ইমেজ ও পরম বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠান। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের ১৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেই ভারতের সেনাবাহিনী এদেশ ছেড়ে চলে যান। 

 

তখন বিশ্ব মিডিয়ায় আবার ঝড় ওঠে। অনেকেই লিখেন, একজন নেতার নেতৃত্বে কয়েক মাসের ব্যবধানে একটি রাষ্ট্র দুইবার স্বাধীন হলো; যা বিশ্ব ইতিহাসে একমাত্র। পৃথিবীতে কোনও দেশের সৈন্যবাহিনী অপর একটি দেশে বন্ধুর বেশে বা শত্রুর বেশে প্রবেশ করলে এত সহজে চলে যায় না। দুই বা ততোধিক রাষ্ট্র যতই বন্ধু হোক, এই বন্ধুত্ব ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নয়। দু'টি রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব হয় পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান ও বিশালতার কারণে বাংলাদেশের ছোট্ট ভূখণ্ডটির কৌশলগত গুরুত্ব ভারতের নিকট অপরিসীম। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর অনেক ছোট ছোট ভূখণ্ড দেশটির আওতাভুক্ত ছিল না। তারা তাদের কৌশলগত নিরাপত্তা ও অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অনেক এলাকা ভারতভুক্ত করে তাদের রাষ্ট্র সংহত করেছে। 

 

এমনকি ১৯৭৫ সালের দিকে সিকিম ভারতভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি তাদের রাষ্ট্র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। আমাদের পশ্চিমে বিশাল ভারত এবং উত্তর ও পূর্ব দিকে তাদের সমস্যা সঙ্কুল বিস্তীর্ণ এলাকা। দেশটির দ্রুততর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আমাদের ভূখণ্ডটি ভারতের নিকট অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জাতির জনক গভীর রাষ্ট্রচিন্তাবোধ থেকে কোনও ধরনের ঝুঁকি নেননি। সম্পর্ক উষ্ণ থাকতেই প্রথম সুযোগে তিনি মিত্রবাহিনীকে ফেরত পাঠিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করেছেন। 


অপর রাষ্ট্র যত অকৃত্রিম বন্ধুই হোক, কোনও দেশের এক প্লাটুন পেশাদার সৈন্যের অপর দেশে উপস্থিতি সুখকর ও স্বস্তিকর নয়। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে দশকের পর দশক ধরে অপর দেশের সৈন্যের উপস্থিতি রয়েছে; যা তাদের জন্য বেশ অস্বস্তিকর। এখানেই বঙ্গবন্ধুর বিশালতা ও দেশপ্রেম আরো বিস্তীর্ণ। তিনি কেবল দেশ স্বাধীন করেননি, স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ ও সংহত করেছেন। সেই সময়ে ভারতের বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধ পরবর্তীতে চারিদিকে অস্ত্রের সমাহার, নিজস্ব সৈন্যবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপ্রতুলতা, ভঙ্গুর রাষ্ট্রীয় কাঠামো, পাকিস্তানপন্থী সশস্ত্র দেশদ্রোহী, চরম বামপন্থী সশস্ত্র উগ্রপন্থা এবং নিজের ক্ষমতা সুসংহত করণ ও দেশগঠনে ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতি সহায়ক হবে বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন। 

 

শেখ মুজিব এক মিনিটের কম সময়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সঙ্গে মিসেস গান্ধীর বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শটি গ্রহণ করেননি। ক্ষমতার কাঙাল তিনি ছিলেন না, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠাই তাঁর জীবনের মূখ্য ও একমাত্র বিষয় ছিল। বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে সামান্য আপোস করলে দীর্ঘকাল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থাকতে পারতেন। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের সঙ্গে নিজের পরিবারের নাম যুক্ত করে ২৩ পরিবারের সৃষ্টি করতে পারতেন। ক্ষমতা ও আয়েশী জীবনের পরিবর্তে তিনি কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। একটি রাষ্ট্র কাঠামোতে নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টির উদ্যোগ ওই রাষ্ট্রের জন্য দেশদ্রোহিতার অপরাধ এবং এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। 


বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধু জীবননাশের ঝুঁকি নিয়েই সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি অবশ্যই পাকিস্তানিদের চোখে পাকিস্তানদ্রোহী। কিন্তু বাঙালিরা যখন তাঁর প্রতি অসম্মান করার সুযোগ খোঁজেন, তখন শেখ মুজিব খাটো হন না, বরং ওই বাঙালির জন্ম প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়। 
যারা নানা অজুহাতে তাঁর বিরোধিতা করেন, প্রভুদের মদদে পরপারে চলে যাওয়া মহৎ মানুষটিকে ছোট করে পৈশাচিক সুখ অনুভব করেন। তারাও জানেন যে, কৌশলগত কারণে এই দেশে ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি এদেশের হিন্দু জনগণের জন্য অধিক নিরাপত্তামূলক ও সুখকর হতো, মুসলমানদের জন্য স্বস্তিকর হতো না। এরপরও জেনেশুনে এই অপকর্ম করার জন্য সবসময় ছোঁক ছোঁক করেন। 

 

অনেক পাকিস্তান প্রেমী মনে করেন, অখণ্ড পাকিস্তানে মুসলমানরা অধিক শক্তিশালী ছিলেন এবং আমাদের স্বার্থরক্ষা বেশী হতো। তারা হয় মূর্খ অথবা এতটায় প্রভুভক্ত যে কখনো কখনো ইসলামে পরিপূর্ণ নিষেধ থাকা সত্বেও মানব প্রভুদের সেজদা করে অথবা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে সেজদা তুল্য অপরাধ করে ফেলেন। বস্তুত পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এদেশের মানুষের অসহায়ত্বের কথা কি তারা ভুলে গেছেন? 

 

বস্তুত পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রায় সব সরকারি পদ এবং ব্যবসা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা দখল করে নিয়েছিল। এমন কি,পাকিস্তানিরা ভারত থেকে আসা বিহারী, বাঙালি ও অপরাপর ভাষাভাষীদের অধিক পছন্দ ও বিশ্বাস করতো। বিধায় এদেশে শাসক শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় ওদের অর্থ, প্রভাব ও অবস্থান সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হলে এই ৫০ বছরে আমরা ফিলিস্তিনীদের ন্যায় নিজ দেশে পরবাসী হয়ে উঠতাম। বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা, শিল্প, সরকারি অবস্থানের বিকাশ হতো না। এরপরও ধর্মব্যবসায়ীগণ কারণে অকারণে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে তাদের নিজস্ব যৌন সংস্কৃতির বিকৃত সুখানুভূতি পান। 

 

ধর্মের নামে ভোটের ব্যবসা করা এবং অর্থ, রাজকীয় খানাপিনা ও সেবাগ্রহণকারী ধর্ম প্রচারকদের চেয়ে এদেশে ইসলাম বিকাশের ক্ষেত্রে জাতির পিতা এবং তাঁর মহীয়সী কন্যার অবদান অনেক বেশি। ইসলামী ফাউন্ডেশন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, ওআইসি'র সদস্য পদ লাভ, মদ-জুয়ার মতো ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড সংবিধানে নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ইসলাম শিক্ষার প্রসার, বঙ্গবন্ধু কন্যা কর্তৃক রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মসজিদ নির্মাণ, ইসলামী-আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ক্বওমী শিক্ষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, এবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, মসজিদ ভিত্তিক কোরআন শিক্ষা চালু করে ইসলামী শিক্ষার প্রসার এবং ধর্ম শিক্ষক হিসেবে আলেমদের সরকারী কর্মসংস্থান ও সম্মানজনক আয়ের পথ সৃষ্টিসহ ইসলামের পক্ষে অসংখ্য মহৎ কর্ম সম্পাদন করেছেন। 


এরপরও শেখ মুজিব ও তাঁর বিদুষী কন্যার বিরুদ্ধে সহিংসতা করতে এদের বিবেক সামান্য দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। আজকের বিশ্ব বাস্তবতায় বিশ্বের বিভিন্ন জাতি নানাবিধ জোট গঠন করে, ঐক্য গঠন করে পারস্পরিক সহায়তার পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজ নিজ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, জীবন মানের উন্নয়ন করছে। সেখানে কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠী ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে মানবজাতির ক্ষতি সাধন করছে। আমরা আয়তনে ছোট হলেও ভারতের নিকট কৌশলগত কারণে আমাদের গুরুত্ব অপরিসীম। তেমনি বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের গুরুত্বও আমাদের নিকট নিত্য প্রয়োজনীয়। আমরা একে অপরের প্রতি বিদ্বেষমূলক হলে উভয় জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। 

 

বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলে এবং পানি সমস্যাসহ উভয় রাষ্ট্রের কিছু কিছু অভিন্ন সমস্যা খোলামনে আলোচনা করে যৌথভাবে বিজ্ঞানের সর্বশেষ উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি ধারণ করে সমাধানের উদ্যোগ নিলে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে। মুসলমান-হিন্দু, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই উপকৃত হবে। এমনকি ভারত বড় রাষ্ট্র হিসেবে অধিকতর উদার হয়ে নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করে পানি সমস্যার স্থায়ী ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের উদ্যোগ নিলে ভারত, বাংলাদেশ উভয় দেশের পানি সমস্যা পানি সম্পদে পরিণত হতে পারে। উভয় রাষ্ট্র পানি সঙ্কট, বন্যা, খরা থেকে রক্ষা পেয়ে এক সোনালী ভবিষ্যতের সোপান রচনা করতে পারে। নেপাল ও ভুটান পানি ভিত্তিক এক নতুন আয়ের দ্বার উম্মোচন করতে পারে। 

 

হিংসা, বিদ্বেষ কেবল সমস্যার সৃষ্টি করে। মানব সভ্যতার অগ্রগতি, উন্নয়ন, জীবন মানের ইতিবাচক পরিবর্তন বাধাগ্রস্ত করে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, পরমতসহিষ্ণু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তে নিয়ামক শক্তি হিসেবে ভুমিকা রাখে। বাংলাদেশ ও ভারত একে অপরের বিরোধিতা করলে উভয় দেশে জঙ্গীবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটবে। মানুষ, জাতি, ধর্মের চরম ক্ষতি সাধন হবে। আর সম্মানজনক বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করলে শান্তি, উন্নয়ন ও মানবের পরম উন্নতি সাধন সম্ভব।  সুতরাং, বিরোধিতার কারণে নিছক বিরোধিতা না করে আসুন সবাই মিলে পারস্পরিক সহযোগিতার মন প্রসারিত করে সবার জন্য সম্মানজনক বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে শান্তির পথে সমৃদ্ধি রচনা করি।

 

 

লেখক : আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন

জাতীয় সংসদ সদস্য, জয়পুরহাট-২

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর